
বাংলাদেশের বিদেশস্থ দূতাবাস, হাইকমিশন, কনস্যুলেট ও কূটনৈতিক মিশনগুলোতে হঠাৎ করেই পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সম্প্রতি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে—সকল মিশন, কনস্যুলেট, কূটনীতিকদের কার্যালয় ও সরকারি বাসভবন থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরিয়ে ফেলার জন্য বলা হয়েছে।
কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, এই নির্দেশনা আনুষ্ঠানিক কোনো সরকারি প্রজ্ঞাপন, চিঠি বা ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠানো হয়নি। বরং অঞ্চলভিত্তিক কয়েকজন রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারকে টেলিফোনে জানানো হয়েছে। পরে তাঁদের মাধ্যমে অন্য দূতাবাস ও মিশনগুলোতে খবরটি পৌঁছে দেওয়া হয়।
হঠাৎ কেন এই নির্দেশনা?
বাংলাদেশের কূটনৈতিক ইতিহাসে এমন নির্দেশনা বিরল। সাধারণত রাষ্ট্রপতির ছবি সরকারি ভবন, কনফারেন্স রুম ও আনুষ্ঠানিক স্থাপনায় টাঙানো হয় রাষ্ট্রীয় প্রোটোকলের অংশ হিসেবেই। কিন্তু এবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গন ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা চলছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের মেয়াদ শেষের সময় ঘনিয়ে আসায় অথবা সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে। তবে সরকারিভাবে এখনো এ বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
নির্দেশনা পৌঁছানোর পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন
সাধারণত মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশি মিশনে যে কোনো সিদ্ধান্ত বা নির্দেশনা পাঠানো হয় সরকারি নোটিস বা অফিসিয়াল ই-মেইলের মাধ্যমে। কিন্তু এবার তা হয়নি। কূটনৈতিক সূত্রের ভাষায়, “এটি অনেকটা মৌখিক নির্দেশনার মতো শোনাচ্ছে।”
এমনকি কিছু রাষ্ট্রদূত জানিয়েছেন, তাঁরা হঠাৎ করে ফোনকল পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন। কারণ এত গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা সাধারণত গোপনীয় হলেও লিখিতভাবে পৌঁছে দেওয়া হয়। ফলে নির্দেশনার বৈধতা ও উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের প্রতিক্রিয়া
প্রবাসী বাংলাদেশি কমিউনিটিগুলো সাধারণত নিজেদের দূতাবাস ও হাইকমিশনে গিয়ে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করে। সেসব কার্যালয়ে রাষ্ট্রপতির ছবি দেখা যায়, যা প্রবাসীদের কাছে রাষ্ট্রীয় সম্মানের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়।
ছবি সরানোর খবর জানাজানি হওয়ার পর অনেক প্রবাসী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, রাষ্ট্রপতি দেশের সাংবিধানিক প্রধান। তাই এভাবে ছবি সরানোর নির্দেশ দেশ ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তির সঙ্গে যায় না।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাব
কূটনৈতিক সম্পর্ক শুধু সরকারি কর্মকাণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতীক ও আনুষ্ঠানিকতার সঙ্গেও জড়িত। রাষ্ট্রপতির ছবি অফিসে টাঙানো একটি আন্তর্জাতিক প্রথা। এই ছবি সরানোর ফলে বিদেশি কর্মকর্তারা এবং স্থানীয় প্রশাসনের কাছে প্রশ্ন তৈরি হতে পারে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিদেশি গণমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিতে পারে। এর ফলে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভাবমূর্তি সাময়িকভাবে হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষণ
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন রাষ্ট্রের প্রধান। যদিও কার্যনির্বাহী ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকে, তবুও রাষ্ট্রপতির পদ সর্বোচ্চ মর্যাদার প্রতীক। তাই হঠাৎ করে রাষ্ট্রপতির ছবি সরানোর সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক তাৎপর্যের ইঙ্গিত বহন করতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার হয়তো নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর আগে বা ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কৌশল হিসেবে এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে পরিষ্কার ব্যাখ্যা না দেওয়া পর্যন্ত এর প্রকৃত কারণ অজানা রয়ে যাবে।
অতীতের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের ইতিহাসে রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর ছবি সরকারি অফিসে প্রদর্শনের প্রথা দীর্ঘদিনের। অতীতে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সময় কিছু ছবি সরানোর ঘটনা ঘটেছে বটে, তবে তা সাধারণত শাসন পরিবর্তনের পরপরই হয়েছে। চলমান সরকারের মেয়াদে এমন ঘটনা ঘটায় বিষয়টি আরও আলোচিত হয়ে উঠেছে।
জনমত ও গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যম এ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে তুমুল আলোচনা। অনেকে বলছেন, এটি একটি অস্বাভাবিক সিদ্ধান্ত, যা সরকারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে।
অন্যদিকে কিছু রাজনৈতিক দল মনে করছে, এটি সরকারপ্রধানের সিদ্ধান্তকে আরও প্রাধান্য দেওয়ার কৌশল হতে পারে। ফলে সামনে রাজনৈতিক অঙ্গনে এ নিয়ে বিতর্ক আরও বাড়তে পারে।
সম্ভাব্য ফলাফল
১. কূটনৈতিক বিভ্রান্তি: বিদেশি মিশনের কর্মকর্তারা বিভ্রান্ত হতে পারেন, কোন নির্দেশ মানা উচিত তা বুঝতে।
২. প্রবাসীদের আস্থা কমতে পারে: প্রবাসী বাংলাদেশিরা হয়তো মনে করতে পারেন, রাষ্ট্রীয় প্রতীক অবহেলা করা হচ্ছে।
৩. আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে আলোচনার ঝড়: বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে নতুন করে রিপোর্ট আসতে পারে।
৪. দেশীয় রাজনীতিতে বিতর্ক: বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এ নিয়ে সরকারের সমালোচনা বাড়াতে পা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাস, হাইকমিশন, কনস্যুলেট ও কূটনৈতিক কার্যালয় থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ছবি সরানোর ঘটনা নিঃসন্দেহে একটি বড় খবর। এর পেছনের প্রকৃত কারণ ও উদ্দেশ্য এখনো অজানা। তবে বিষয়টি দেশ-বিদেশে আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
যতক্ষণ পর্যন্ত সরকারিভাবে এ নিয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা না আসে, ততক্ষণ পর্যন্ত জনমনে নানা প্রশ্ন ও জল্পনা-কল্পনা চলতেই থাকবে।