
ইসলামের মূল শিক্ষা বোঝার জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাদীস হলো হাদীসে জিব্রাইল। এ হাদীসকে অনেক আলেম “উম্মুস সুন্নাহ” বা সুন্নাহর মা বলেছেন। কেননা এতে ইসলাম, ঈমান, ইহসান এবং কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ ﷺ সংক্ষিপ্ত অথচ পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
এই হাদীসটি বোঝার মাধ্যমে একজন মুসলমান তাঁর দ্বীনের পূর্ণ কাঠামো অনুধাবন করতে পারে।
—
হাদীসের আরবি
عَنْ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ:
بَيْنَمَا نَحْنُ جُلُوسٌ عِنْدَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ ذَاتَ يَوْمٍ، إِذْ طَلَعَ عَلَيْنَا رَجُلٌ شَدِيدُ بَيَاضِ الثِّيَابِ، شَدِيدُ سَوَادِ الشَّعَرِ، لَا يُرَى عَلَيْهِ أَثَرُ السَّفَرِ، وَلَا يَعْرِفُهُ مِنَّا أَحَدٌ …
إلَى أَنْ قَالَ: «فَإِنَّهُ جِبْرِيلُ أَتَاكُمْ يُعَلِّمُكُمْ دِينَكُمْ».
(সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮)
—
হাদীসের বাংলা অনুবাদ
উমর ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) বলেন:
আমরা একদিন রাসূল ﷺ -এর কাছে বসে ছিলাম, তখন এক অচেনা ব্যক্তি এলেন। তাঁর কাপড় ছিল খুব সাদা, চুল ছিল কালো, ভ্রমণের কোন চিহ্ন দেখা যাচ্ছিল না, অথচ আমরা কেউ তাঁকে চিনতাম না। তিনি এসে নবী ﷺ এর সামনে বসলেন, হাঁটু নবীর হাঁটুর সাথে মিলালেন এবং বললেন:
“হে মুহাম্মদ! আমাকে ইসলাম সম্পর্কে বলুন।”
নবী ﷺ বললেন: “ইসলাম হল, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল—এ সাক্ষ্য দেওয়া, নামায পড়া, যাকাত দেওয়া, রমজানে রোজা রাখা ও হজ করা (যদি সামর্থ্য থাকে)।”
তিনি আবার বললেন: “আমাকে ঈমান সম্পর্কে বলুন।”
নবী ﷺ বললেন: “ঈমান হল আল্লাহ, তাঁর ফেরেশতাগণ, কিতাবসমূহ, রাসূলগণ, আখেরাত ও তাকদীরের উপর বিশ্বাস রাখা।”
তিনি আবার বললেন: “আমাকে ইহসান সম্পর্কে বলুন।”
নবী ﷺ বললেন: “তুমি আল্লাহর ইবাদত করবে এমনভাবে যেন তুমি তাঁকে দেখতে পাচ্ছ। যদি তুমি তাঁকে দেখতে না পার, তবে অবশ্যই তিনি তোমাকে দেখছেন।”
তিনি আবার বললেন: “আমাকে কিয়ামত সম্পর্কে বলুন।”
নবী ﷺ বললেন: “প্রশ্নকৃত ব্যক্তি প্রশ্নকারীর চেয়ে বেশি জানে না।”
তিনি আবার বললেন: “তাহলে কিয়ামতের আলামত বলুন।”
নবী ﷺ বললেন: “দাসী তার প্রভুকে জন্ম দেবে, আর গরীব মেষপালকেরা অট্টালিকা নির্মাণে প্রতিযোগিতা করবে।”
এরপর লোকটি চলে গেল। রাসূল ﷺ বললেন:
“হে উমর! তুমি জানো সে কে ছিল? সে ছিল জিব্রাইল (আঃ)। সে তোমাদের দ্বীন শেখাতে এসেছিল।”
—
হাদীসের মূল ব্যাখ্যা
১. ইসলাম
হাদীসে ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।
শাহাদাহ — আল্লাহর একত্ব ও রাসূলের রিসালাতের সাক্ষ্য।
সালাত — দিনে পাঁচবার আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন।
যাকাত — সম্পদ থেকে দরিদ্রের হক আদায়।
সাওম — রমজানে আত্মশুদ্ধি।
হজ — আল্লাহর ঘরে গিয়ে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ।
➡️ ইসলামের বাহ্যিক প্রকাশ বা পরিচয় এগুলোই।
—
২. ঈমান
ঈমানের ছয়টি স্তম্ভ:
1. আল্লাহতে বিশ্বাস।
2. ফেরেশতাগণে বিশ্বাস।
3. কিতাবসমূহে বিশ্বাস।
4. রাসূলগণে বিশ্বাস।
5. আখেরাতে বিশ্বাস।
6. তাকদীরে বিশ্বাস (ভাল-মন্দ সবকিছু আল্লাহর নির্ধারিত)।
➡️ এগুলো অন্তরের বিশ্বাস ও মানসিক দৃঢ়তার সাথে জড়িত।
—
৩. ইহসান
ইহসান হলো দ্বীনের সৌন্দর্য।
ইবাদতে গভীর মনোযোগ রাখা।
আল্লাহকে সামনে কল্পনা করে ইবাদত করা।
সর্বদা এই বিশ্বাস রাখা যে, আল্লাহ আমাদের দেখছেন।
➡️ ইহসান ছাড়া ইসলাম ও ঈমান পূর্ণাঙ্গ হয় না।
—
৪. কিয়ামতের জ্ঞান
রাসূল ﷺ বলেছেন: কিয়ামতের সঠিক সময় আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। তবে কিছু আলামত বলা হয়েছে—
দাসী তার প্রভুকে জন্ম দেবে → সমাজে উল্টাপাল্টা সম্পর্ক, মা-বাবার অবাধ্যতা।
গরীব মানুষ অট্টালিকা বানাতে প্রতিযোগিতা করবে → হঠাৎ সম্পদশালী হওয়া ও অহংকার।
➡️ আজকের সমাজে আমরা এসব আলামত দেখতে পাচ্ছি।
—
হাদীস থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা
1. ইসলামের পূর্ণ কাঠামো ইসলাম, ঈমান ও ইহসান—এই তিন ভাগে বিভক্ত।
2. ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ মেনে চলা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ।
3. ঈমানের ছয়টি বিষয় অস্বীকার করলে ঈমান অপূর্ণ হয়।
4. ইহসান হলো দ্বীনের আধ্যাত্মিক সৌন্দর্য, যা মুমিনকে আল্লাহর নৈকট্য এনে দেয়।
5. কিয়ামতের সঠিক জ্ঞান শুধু আল্লাহর কাছে আছে, তবে আলামত দেখে মানুষ প্রস্তুত হতে পারবে।
6. জিব্রাইল (আঃ) ফেরেশতাদের মাঝে বিশেষ মর্যাদার অধিকারী, যিনি দ্বীনের শিক্ষা দেওয়ার জন্য নবীর কাছে এসেছিলেন।
—
আধুনিক যুগে প্রাসঙ্গিকতা
শাহাদাহ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, একমাত্র আল্লাহই আমাদের স্রষ্টা।
সালাত ব্যস্ত জীবনে আত্মিক শান্তি দেয়।
যাকাত দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
সাওম শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধি আনে।
হজ বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের প্রতীক।
ইহসান আমাদের কাজকে সুন্দর করে, দুর্নীতি থেকে দূরে রাখে।
কিয়ামতের আলামত আমাদের সতর্ক করে দেয় যে, এই দুনিয়া চিরস্থায়ী নয়।
—
উপসংহার
হাদীসে জিব্রাইল ইসলামের এক অনন্য দলিল। এখানে ইসলাম, ঈমান ও ইহসানের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো তুলে ধরা হয়েছে। একজন মুসলমানের জীবনে এ হাদীসের শিক্ষা ধারণ করা অপরিহার্য। আজকের আধুনিক দুনিয়াতেও এ শিক্ষাগুলো অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
➡️ তাই বলা হয়, এই হাদীসটি ইসলাম বোঝার ভিত্তি। যে মুসলমান এই হাদীস বুঝে নেবে, তার কাছে দ্বীনের মূল বিষয়গুলো পরিষ্কার হয়ে যাবে।