
সৌদি আরব বিশ্বের অন্যতম মরুভূমি প্রধান দেশ। প্রাকৃতিক পানির উৎস সীমিত এবং ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা দিন দিন বাড়ছে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, কৃষি উৎপাদন, শিল্পের চাহিদা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দেশটি ভয়াবহ পানি সংকট ও মরুকরণের ঝুঁকিতে রয়েছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সৌদি সরকার কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রযুক্তি বা ক্লাউড সিডিং প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এই কর্মসূচি মূলত পানির উৎস বৃদ্ধি, বনাঞ্চল সম্প্রসারণ এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য নেওয়া হয়েছে।
—
সৌদি আরবে ক্লাউড সিডিং প্রকল্প
‘দ্য সৌদি রিজিওনাল ক্লাউড সিডিং প্রোগ্রাম’-এর আওতায় প্রাথমিকভাবে ছয়টি অঞ্চলে কার্যক্রম চালু করা হয়েছে। এগুলো হলো—
রিয়াদ
কাসিম
হাইল
মক্কা
আল-বাহা
আসির
প্রথম ধাপে রিয়াদ, হাইল ও কাসিম অঞ্চলে কার্যক্রম শুরু হয়। পরবর্তী ধাপে অন্যান্য অঞ্চলে সম্প্রসারণের পরিকল্পনা রয়েছে।
সৌদি যুবরাজ ও প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমান এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন ‘মিডল ইস্ট গ্রিন সামিট’-এর অংশ হিসেবে। এটি দেশের ভিশন ২০৩০ লক্ষ্য অর্জনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
—
ক্লাউড সিডিং কী?
ক্লাউড সিডিং হলো এমন একটি আধুনিক প্রযুক্তি যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট ধরনের মেঘে রাসায়নিক ছিটিয়ে বৃষ্টিপাত কৃত্রিমভাবে ঘটানো হয়। এতে মেঘের ভেতরে পানিকণা জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
সৌদি আরব জানিয়েছে, এই প্রকল্পে যে রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব এবং প্রকৃতির জন্য কোনো ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে না। বিশেষায়িত উড়োজাহাজ ব্যবহার করা হচ্ছে যেগুলো আকাশে নির্দিষ্ট উচ্চতায় গিয়ে সঠিক মেঘ নির্বাচন করে রাসায়নিক প্রয়োগ করছে।
—
সৌদি আরবে ক্লাউড সিডিংয়ের ইতিহাস
প্রথম পরীক্ষামূলক কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৮৬ সালে।
এরপর ২০০৪ সালে আসির অঞ্চলে গবেষণা চালানো হয়।
২০০৬ সালে মধ্য অঞ্চলে পরীক্ষামূলক প্রয়োগ হয়।
আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকল্পের সূচনা হয় ২০২২ সালে।
এই সময়ের মধ্যে সৌদি আরব নিজস্ব প্রযুক্তি ও উড়োজাহাজ তৈরি করেছে। প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আইমান আল-বার জানিয়েছেন, বর্তমানে স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষ জনবলও প্রস্তুত রয়েছে।
—
সাম্প্রতিক অগ্রগতি
২০২২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
৭৫২টি ফ্লাইট পরিচালনা করা হয়েছে, মোট সময় ১,৮৭৯ ঘণ্টা।
গবেষণার জন্য আলাদা ৫১টি ফ্লাইট হয়েছে, যার সময়কাল ১৬৯ ঘণ্টা।
সম্প্রতি আগস্ট মাসে রামাহ গভর্নরেটে এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের ফ্লাইটে প্রাথমিকভাবে মেঘের পানির পরিমাণ বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
—
আবহাওয়াজনিত চ্যালেঞ্জ
সৌদি আরবের গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া অত্যন্ত উষ্ণ ও শুষ্ক। এই কারণে ক্লাউড সিডিং কার্যক্রম আরও জটিল হয়ে ওঠে। সাধারণত ক্লাউড বেস সিডিং এবং ক্লাউড টপ সিডিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, দেশের ভৌগোলিক অবস্থা ও তাপমাত্রার কারণে সঠিক সময়ে সঠিক মেঘ চিহ্নিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
—
কেন এই প্রকল্প গুরুত্বপূর্ণ?
1. মরুকরণ রোধ – সৌদি আরবের বিশাল অংশ মরুভূমি। কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের মাধ্যমে নতুন বনভূমি সৃষ্টি এবং সবুজায়ন বাড়ানো সম্ভব হবে।
2. পানি সংকট মোকাবিলা – ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমবে এবং কৃষি ও শিল্পে নতুন পানির উৎস তৈরি হবে।
3. কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি – পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে।
4. ভিশন ২০৩০ অর্জন – পরিবেশ সংরক্ষণ এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য সৌদি আরবের যে পরিকল্পনা রয়েছে, এই প্রকল্প তা অর্জনে বড় ভূমিকা রাখবে।
—
আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ
বিশ্বজুড়ে ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি নতুন কিছু নয়। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ আরও অনেক দেশ কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। তবে সৌদি আরবের বিশেষত্ব হলো—তারা নিজস্ব প্রযুক্তি ও পরিবেশবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করছে। ফলে এই কর্মসূচি শুধু দেশেই নয়, বরং পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য একটি মডেল হতে পারে।
—
সমালোচনা ও বিতর্ক
যদিও সৌদি আরব বলছে ক্লাউড সিডিং পরিবেশবান্ধব, তবুও কিছু বিজ্ঞানী সতর্ক করেছেন যে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব পর্যবেক্ষণ করা জরুরি। বিশেষ করে—
মাটির গুণাগুণ পরিবর্তন
বায়ুমণ্ডলের ভারসাম্য
প্রতিবেশ ব্যবস্থায় প্রভাব
এসব বিষয়ে আরও গবেষণা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সৌদি আরবের কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রকল্প শুধু পানি সংকট ও মরুকরণ রোধেই নয়, বরং একটি পরিবেশবান্ধব ভবিষ্যতের দিকে পদক্ষেপ। এটি ভিশন ২০৩০ অর্জনের অন্যতম মাইলফলক। যদি সফলভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে মরুভূমিকে সবুজে পরিণত করা এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার পথে সৌদি আরব নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।