- 

ফাউমি মুরগী পালন  
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে পোল্ট্রি ফার্মিং একটি লাভজনক উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত। এর মধ্যে ফাওমি মুরগি পালন বিশেষভাবে জনপ্রিয় কারণ এই জাতটি বাংলাদেশের আবহাওয়ার সাথে অভিযোজিত এবং অল্প খরচে উচ্চ ফলন দেয়। ফাওমি মুরগি, যা মিশরের ফাইয়াম প্রদেশ থেকে উৎপত্তি লাভ করেছে, এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, দ্রুত বৃদ্ধি এবং ডিম উৎপাদন ক্ষমতার জন্য পরিচিত। এই আর্টিকেলে আমরা ফাওমি মুরগির খামার তৈরি, পরিচর্যা এবং লাভজনক পালনের বিস্তারিত পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করব।
## ফাওমি মুরগির বৈশিষ্ট্য
ফাওমি মুরগি একটি প্রাচীন মিশরীয় জাত, যা নীল নদের আশেপাশে হাজার বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে। এই মুরগির কিছু উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো:
– **শারীরিক গঠন**: ফাওমি মুরগি হালকা জাতের মুরগি। এদের নীলাভ কালো পা, লালচে কানের লতি এবং মাঝারি আকারের একক ঝুঁটি রয়েছে। শরীরে সিলভার-সাদা ও কালো ছোপযুক্ত পালক থাকে।
– **ডিম উৎপাদন**: ফাওমি মুরগি ডিম উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। এরা বছরে ২৫০-২৬০টি ছোট আকারের সাদা ডিম দেয়।
– **রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা**: এই জাতটি উষ্ণ জলবায়ুতে অভিযোজিত এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি, যা বাংলাদেশের আর্দ্র পরিবেশে পালনের জন্য উপযুক্ত।
– **আচরণ**: ফাওমি মুরগি প্রাণবন্ত এবং উড়াউড়ি করতে পছন্দ করে। এরা সম্পূর্ণরূপে পোষ মানে না, তবে সঠিক পরিচর্যায় পালন করা সম্ভব।
## ফাওমি মুরগির খামার তৈরির নিয়ম
### ১. খামারের স্থান নির্বাচন
খামার তৈরির জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে:
– **উঁচু ও শুকনো জায়গা**: খামারের জায়গা উঁচু এবং বৃষ্টির পানি জমে না এমন হতে হবে।
– **বাতাস চলাচল**: ঘরে পর্যাপ্ত আলো ও বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
– **নিরাপত্তা**: খামারের চারপাশে শিয়াল, কুকুর বা অন্যান্য শিকারী প্রাণী থেকে রক্ষার জন্য বেড়া দেওয়া উচিত।
– **পানি ও বিদ্যুৎ**: বিশুদ্ধ পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের সুবিধা থাকতে হবে।
### ২. ঘর তৈরি
ফাওমি মুরগির জন্য খোলামেলা ঘর প্রয়োজন। ঘর তৈরির সময় নিম্নলিখিত বিষয়গুলো লক্ষ্য রাখতে হবে:
– **আকার**: প্রতি ১০-১৫টি মুরগির জন্য ১.৫ মিটার (৫ ফুট) লম্বা, ১.২ মিটার (৪ ফুট) চওড়া এবং ১ মিটার (৩.৫ ফুট) উঁচু ঘর তৈরি করতে হবে।
– **উপকরণ**: বাঁশের তরজা, কাঠের তক্তা বা মাটির দেয়াল দিয়ে ঘর তৈরি করা যায়। চালের জন্য খড়, টিন বা পলিথিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
– **বায়ুচলাচল**: ঘরে আলো ও বাতাস চলাচলের জন্য ছিদ্র বা জানালা রাখতে হবে।
– **মেঝে**: মেঝে শুকনো ও পরিষ্কার রাখতে হবে। তুষ বা খড়ের গুঁড়া দিয়ে লিটার তৈরি করা যায়।
### ৩. মুরগির বাচ্চা সংগ্রহ
– **উৎস**: সরকারি মুরগি প্রজনন খামার (যেমন: ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোর, কুষ্টিয়া) থেকে বিশুদ্ধ ফাওমি মুরগির বাচ্চা সংগ্রহ করতে হবে।
– **বয়স**: ১ দিন বয়সী বাচ্চা কিনলে খরচ কম হয় এবং বৃদ্ধি পর্যবেক্ষণ করা সহজ।
– **ভ্যাকসিন**: রানিক্ষেত ও গামবোরো রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া বাচ্চা কিনতে হবে।
## ফাওমি মুরগির পরিচর্যা পদ্ধতি
### ১. খাদ্য ব্যবস্থাপনা
ফাওমি মুরগির দ্রুত বৃদ্ধি ও ডিম উৎপাদনের জন্য সুষম খাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
– **দৈনিক খাদ্য**: প্রতিটি মুরগি দৈনিক ১০০-১২০ গ্রাম খাদ্য গ্রহণ করে। বাচ্চাদের জন্য ২০-৩০ গ্রাম খাদ্য প্রয়োজন।
– **খাদ্যের উপাদান**: গম, ভুট্টা, ধানের কুঁড়া, খৈল, মাছের গুঁড়া, শাক-সবজির অংশ, পোকামাকড় ইত্যাদি ফাওমি মুরগির জন্য উপযুক্ত।
– **ফ্রি-রেঞ্জ পদ্ধতি**: ফাওমি মুরগি উন্মুক্ত পদ্ধতিতে পালন করলে তারা ঘাস, পাতা ও পোকামাকড় কুড়িয়ে খায়, যা খাদ্য খরচ কমায়।
– **পানি সরবরাহ**: সবসময় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করতে হবে। পানির পাত্র নিয়মিত পরিষ্কার করা জরুরি।
### ২. রোগ প্রতিরোধ
ফাওমি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হলেও নিয়মিত ভ্যাকসিন ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা প্রয়োজন।
– **ভ্যাকসিন তালিকা**:
– **রানিক্ষেত রোগ**: ১ম দিনে BCRDV ভ্যাকসিন এবং ৭ম দিনে RDV ভ্যাকসিন।
– **গামবোরো রোগ**: ১৪তম দিনে Gumboro D78 ভ্যাকসিন।
– **ফাউল পক্স**: ২৮তম দিনে ভ্যাকসিন।
– **পরিচ্ছন্নতা**: খামার প্রতি সপ্তাহে পরিষ্কার করতে হবে। বিষ্ঠা অপসারণ ও লিটার পরিবর্তন করা জরুরি।
– **পর্যবেক্ষণ**: মুরগির অস্বাভাবিক আচরণ, খাওয়ার অভ্যাস বা শারীরিক সমস্যা লক্ষ্য করতে হবে।
### ৩. ডিম উৎপাদন ও ফুটানো
– **ডিম পাড়ার সময়**: ফাওমি মুরগি ৪.৫-৫ মাস বয়সে ডিম পাড়া শুরু করে।
– **ডিম সংগ্রহ**: ডিম নিয়মিত সংগ্রহ করতে হবে যাতে ভাঙার ঝুঁকি কমে।
– **ইনকিউবেশন**: ফাওমি মুরগি সাধারণত কুচে হয় না। তাই ডিম ফোটানোর জন্য ইনকিউবেটর ব্যবহার করতে হবে।
## লাভজনক ফাওমি মুরগি পালনের কৌশল
### ১. খরচ হ্রাস
– **ঘরের উপকরণ**: স্থানীয় ও সাশ্রয়ী উপকরণ ব্যবহার করে ঘর তৈরি করলে খরচ কমে।
– **খাদ্য ব্যবস্থাপনা**: বাড়ির ফেলে দেওয়া খাবার, শাক-সবজির অংশ ও ঘাস ব্যবহার করলে খাদ্য খরচ কমবে।
– **ফ্রি-রেঞ্জ পদ্ধতি**: ফাওমি মুরগি উন্মুক্ত জায়গায় পালন করলে তারা নিজেরাই খাবার সংগ্রহ করে, যা খরচ কমায়।
### ২. আয়ের উৎস
– **ডিম বিক্রি**: ফাওমি মুরগি বছরে ২৫০-২৬০টি ডিম দেয়। প্রতিটি ডিম ৮-১০ টাকায় বিক্রি করা যায়।
– **মুরগি বিক্রি**: ২ মাস বয়সে মোরগ (২ কেজি) এবং ২.১৫ মাসে মুরগি (১.৫ কেজি) বিক্রয়ের জন্য উপযুক্ত। প্রতি কেজি মাংস ৩০০-৪০০ টাকায় বিক্রি করা যায়।
– **বিষ্ঠা বিক্রি**: মুরগির বিষ্ঠা জৈব সার হিসেবে বিক্রি করে অতিরিক্ত আয় করা যায়।
৩. আয়-ব্যয় হিসাব
**ব্যয়**:
– **ঘর তৈরি**: ১০-১৫ মুরগির জন্য ঘর তৈরি খরচ প্রায় ২,০০০ টাকা।
– **বাচ্চা ক্রয়**: ১ দিন বয়সী বাচ্চা প্রতিটি ৩০ টাকা, ১০টি বাচ্চার জন্য ৩০০ টাকা।
– **খাদ্য**: প্রতি মাসে ১০টি মুরগির জন্য খাদ্য খরচ প্রায় ৮০০ টাকা।
– **ভ্যাকসিন ও ওষুধ**: বছরে ৫০০-১,০ৰ০ টাকা।
**আয়**:
– **ডিম**: ১০টি মুরগি বছরে ২,৫০০ ডিম দেবে। প্রতিটি ডিম ৮ টাকা হিসেবে মোট আয় ২০,০০০ টাকা।
– **মুরগি বিক্রি**: ৫টি মোরগ (২ কেজি) ৪০০ টাকা/কেজি হিসেবে ৪,০০০ টাকা এবং ৫টি মুরগি (১.৫ কেজি) ৩০০ টাকা/কেজি হিসেবে ২,২৫০ টাকা। মোট ৬,২৫০ টাকা।
– **বিষ্ঠা**: প্রতি মাসে ১০০-২০০ টাকা।
**মোট লাভ**: আয় (২৬,৪৫০ টাকা) – ব্যয় (১২,১০০ টাকা) = ১৪,৩৫০ টাকা (প্রথম বছর
## উপসংহার
ফাওমি মুরগি পালন বাংলাদেশের গ্রামীণ ও শহুরে উভয় অঞ্চলে লাভজনক একটি ব্যবসা। সঠিক পরিকল্পনা, খামার ব্যবস্থাপনা এবং পরিচর্যার মাধ্যমে এই জাতের মুরগি থেকে উচ্চ ফলন ও আয় অর্জন করা সম্ভব। ফাওমি মুরগির রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কম খাদ্যের চাহিদা এবং ডিম উৎপাদন ক্ষমতা এটিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি খামারিদের জন্য আদর্শ পছন্দ করে। আপনি যদি ফাওমি মুরগি পালন শুরু করতে চান, তবে এই গাইড অনুসরণ করে সফলতা অর্জন করতে পারেন।