
জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’: একটি ঐতিহাসিক রূপান্তরের দিকনির্দেশনা
গণ-অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনর্গঠনের পথনকশা
📅 প্রকাশিত: ২৯ জুলাই ২০২৫
✍️ বিশেষ প্রতিবেদন | টুডে দেশ
🔰 ভূমিকা: ইতিহাসের মোড়ে দাঁড়িয়ে এক নতুন পথচলা
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান একটি যুগান্তকারী ঘটনা। শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে সংগঠিত এই গণজাগরণ, যা পরে সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণে রূপ নেয় এক সফল গণ-আন্দোলনে, দেশকে পৌঁছে দিয়েছে এক মৌলিক প্রশ্নে—রাষ্ট্রব্যবস্থা কি শুধুই রূপে বদলাবে, না কি গঠনে, চরিত্রে ও দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তিত হবে?
এই প্রশ্নের উত্তরে যে দলিল উঠে এসেছে, সেটিই ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’—যা এখন রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় চর্চায় আলোচনার কেন্দ্রে।
—
🏛️ সনদের মূল উদ্দেশ্য কী?
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ কেবল একটি রাজনৈতিক প্রস্তাব নয়—এটি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর পুনর্গঠন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার একটি সম্মিলিত রোডম্যাপ।
সনদের লক্ষ্য:
সংবিধান সংস্কার
নির্বাচন ব্যবস্থায় নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা
স্বাধীন বিচার বিভাগ গঠন
জনপ্রশাসনে জবাবদিহিতা আনা
পুলিশ প্রশাসনের অপব্যবহার রোধ
দুর্নীতিবিরোধী বাস্তব সংস্কার
অর্থাৎ এটি কোনো দলের একক পরিকল্পনা নয়, বরং ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দল ও জোটের অংশগ্রহণে গৃহীত এক ঐকমত্যের দলিল।
—
👥 কে লিখল সনদটি?
সনদ প্রণয়নের নেতৃত্বে আছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস, যিনি একটি নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
সনদের পেছনে কাজ করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন, যা ছয়টি পৃথক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ নিয়ে রাজনীতিকদের সঙ্গে সংলাপ চালিয়ে এই খসড়া তৈরি করেছে।
—
📜 পটভূমি: গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংসের প্রতিক্রিয়া
সনদে উল্লেখ রয়েছে, ২০০৯ সাল থেকে রাষ্ট্রে দলীয়করণ ও স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে—
মানবাধিকার লঙ্ঘন,
বিচারহীনতা,
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন,
দুর্নীতিতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর জড়িয়ে পড়া—এসব নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়।
অভিযোগ রয়েছে, দীর্ঘ দেড় দশক ধরে সরকার সংবিধান সংশোধন করে একচ্ছত্র ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করে এবং নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ফেলে।
এরই প্রতিক্রিয়ায় ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে জন্ম নেয় এক অভূতপূর্ব গণ-অভ্যুত্থান, যা সরকার পতনের মাধ্যমে শেষ হয়।
—
🛠️ কি ধরনের সংস্কার প্রস্তাব রয়েছে?
সনদে সংক্ষিপ্তভাবে যে প্রস্তাবগুলো রয়েছে, তার সারমর্ম:
১. সংবিধান সংস্কার
গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা সংরক্ষণ
নির্বাহী ও বিচার বিভাগের ক্ষমতা পৃথককরণ
একনায়কতান্ত্রিক ধারার সংশোধন
২. নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার
নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও জবাবদিহিতা
দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বাতিল
নির্বাচনে সেনাবাহিনী ও অবজারভার ব্যবস্থার মানদণ্ড নির্ধারণ
৩. বিচার বিভাগ সংস্কার
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত বিচারিক নিয়োগ
উচ্চ আদালতের স্বাধীনতা রক্ষা
বিচারাধীন মামলার সময়সীমা নির্ধারণ
৪. জনপ্রশাসন সংস্কার
নিয়োগে দলীয়করণ নিষিদ্ধ
মেধাভিত্তিক পদোন্নতি
সেবার মান নির্ধারণে আইন প্রণয়ন
৫. পুলিশ প্রশাসন সংস্কার
রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ
নির্যাতনবিরোধী আইন
নাগরিক পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু
৬. দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কার
দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তে স্বাধীনতা
কোনো অনুমতির বাধা ছাড়া তদন্তের সুযোগ
রাজনৈতিক দুর্নীতির বিচারে ট্রাইবুনাল
—
📊 কীভাবে কাজ করেছে কমিশনগুলো?
২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে ছয়টি সংস্কার কমিশনের কাজ শুরু
৩১ জানুয়ারি ২০২৫–এর মধ্যে তারা প্রতিবেদন জমা দেয়
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ফেব্রুয়ারি-মে সময়কালে দেশের বড় ৩৮টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৪টি বৈঠক করে
সেখান থেকে গৃহীত হয় সনদের মূল সুপারিশসমূহ
—
📢 সনদের ঘোষণা: কারা সম্মত হয়েছে?
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূত্র অনুযায়ী, সনদের খসড়ার সাথে ইতিমধ্যে ৩৫টির বেশি রাজনৈতিক দল একমত প্রকাশ করেছে। এদের মধ্যে আছে:
বিভিন্ন বাম ও প্রগতিশীল জোট
কিছু ইসলামপন্থি দল
প্রবাসী রাজনৈতিক সংগঠন
তবে এখনো দেশের প্রধান দুটি পুরনো রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে সনদ নিয়ে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি।
—
🔎 জনমত ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
সনদটি জনপরিসরে আসার পর থেকেই সমাজের নানা মহলে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সনদ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির সূচনা হবে।
তরুণ প্রজন্ম এটিকে নিজের আন্দোলনের ফসল বলে মনে করছে।
সমালোচকরাও বলছেন, সনদ বাস্তবায়নের চেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এর রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও মাঠপর্যায়ের প্রয়োগ।
—
📅 বাস্তবায়নের সময়সীমা কী?
সনদের অঙ্গীকারনামায় বলা হয়েছে:
পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের পর দুই বছরের মধ্যে সংবিধান ও আইনের পরিবর্তন সম্পন্ন করতে হবে।
প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে আইনি ও সাংবিধানিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
—
🧭 উপসংহার: এটি কি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পুনর্জন্ম?
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক মাইলফলক রাজনৈতিক দলিল। প্রশ্ন এখন একটাই—এই দলিল কি রাজনৈতিক শক্তির চাপে গৃহীত এক প্রস্তাবমাত্র, নাকি এটি হবে গণতন্ত্রের প্রকৃত ভিত্তি গড়ার রূপরেখা?
উত্তর সময় দেবে। তবে এটুকু নিশ্চিত, এই সনদ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে দীর্ঘ সময় প্রভাব বিস্তার করবে—হোক সেটা ক্ষমতার কেন্দ্রে বা জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষায়।
—
✍️ প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী: TodayDesh Investigative Team
📌 আপনার মতামত জানাতে কমেন্ট করুন বা যোগাযোগ করুন: contact@todaydesh.com