
বাংলাদেশের জাতীয় মাছ হিসেবে পরিচিত ইলিশ শুধু একটি মাছই নয়, বরং বাঙালির আবেগ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। বর্ষার আগমন মানেই ইলিশের মৌসুম। কিন্তু ২০২৫ সালের বর্ষায় ইলিশের দাম নিয়ে দেশের মানুষ বিরাট উদ্বেগে। বাজারে ইলিশের দাম বর্তমানে রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা বেগম সম্প্রতি সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ইলিশের উচ্চমূল্যের পেছনের নানা কারণ তুলে ধরেছেন।この記事টি সেই তথ্যের ভিত্তিতে ইলিশের বর্তমান অবস্থা, দাম বৃদ্ধির কারণ এবং সম্ভাব্য সমাধান নিয়ে বিশ্লেষণ করবে।
📌 ইলিশের বর্তমান বাজার মূল্য
বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ইলিশের দাম কেজিতে ২০০০ টাকার ওপরে চলে গেছে। অনেক জায়গায় ৮০০-১০০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ২২০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। বরিশাল ও চট্টগ্রামের বাজারে কিছুটা কম থাকলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা এখনো ব্যয়বহুল।
📌 ইলিশের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণসমূহ
১. সরবরাহ সংকট
উপদেষ্টা ফরিদা বেগম জানিয়েছেন, এ বছর ইলিশের সরবরাহ অনেক কম। ঢাকার বাজারে এখনও পর্যাপ্ত ইলিশ আসেনি। উপকূলীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টি, নদী উত্তাল থাকা এবং ঝড়-বাদলের কারণে জেলেরা সাগরে বা নদীতে যেতে পারছে না। যার ফলে বাজারে সরবরাহ কমে গেছে।
২. চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব
জেলেদের অভিযোগ, আড়তে চাঁদাবাজি ও নদীপথে চাঁদা আদায়ের কারণে ইলিশ ধরার খরচ বেড়ে গেছে। এসব অবৈধ বাধা দমন করা না গেলে জেলেরা উৎসাহ হারায় এবং বাজারেও প্রভাব পড়ে।
৩. ডিজেলের দাম বৃদ্ধি
মাছ ধরার ট্রলার বা নৌকা চালাতে ডিজেলের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সম্প্রতি ডিজেলের দাম বাড়ায় জেলেদের খরচও বেড়েছে। ফলে সেই খরচ মাছের দামে প্রতিফলিত হচ্ছে।
৪. জাটকা রক্ষায় ব্যর্থতা
সরকারি অভিযানের পরেও জাটকা (অপ্রাপ্তবয়স্ক ইলিশ) নিধন পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি। যার প্রভাব পড়ে পরবর্তী মৌসুমে ইলিশ উৎপাদনের ওপর। এতে উৎপাদন কমে যায় এবং বাজারে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকে।
৫. নদী দূষণ ও নদীর নাব্যতা হ্রাস
নদীতে শিল্প বর্জ্য, পলিথিন ও প্লাস্টিক দূষণের কারণে ইলিশের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। তাছাড়া নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ায় ইলিশের চলাচল ও ডিম পারা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
৬. অনিয়মিত বৃষ্টি ও অতিরিক্ত গরম
ইলিশ সাধারণত বৃষ্টির সময় প্রজননের জন্য নদীতে উঠে আসে। কিন্তু এ বছর সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় ইলিশ নদীতে ডিম পাড়তে পারেনি। এতে ইলিশের সংখ্যা কমে গেছে।
📊 বর্তমান উৎপাদনের পরিসংখ্যান
১২ জুন থেকে ২০ জুলাই ২০২৫ পর্যন্ত দেশে আহরিত হয়েছে প্রায় ৪৬ হাজার ৭৯০ মেট্রিক টন ইলিশ।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ইলিশ উৎপাদন হতে পারে ৫ লাখ ৩৮ হাজার থেকে ৫ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন।
তবে ২০২৩-২৪ সালের মতো যদি উৎপাদন হ্রাসের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে প্রকৃত উৎপাদন আরও কম হতে পারে।
🌍 আন্তর্জাতিক বাজারে ইলিশ রপ্তানি
সৌদি আরবে ১১ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানির অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। আগামী অক্টোবরের মধ্যে এসব মাছ রপ্তানি সম্পন্ন হবে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসীদের চাহিদা মেটাতে এক-দুইটি দেশে পরীক্ষামূলকভাবে ইলিশ রপ্তানি শুরু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
🧪 সরকার কী করছে?
সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসক, নৌ পুলিশ, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনীকে সাথে নিয়ে জাটকা রক্ষা ও অবৈধ মাছ ধরা ঠেকাতে অভিযান চালানো হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকেও ইলিশের দাম কমাতে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তবে এখনো তা বাজারে কার্যকর ফল দিচ্ছে না।
✅ সম্ভাব্য সমাধান
১. চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ
২. জাটকা নিধন ঠেকাতে প্রযুক্তি নির্ভর মনিটরিং
৩. নদীর দূষণরোধে কঠোর পদক্ষেপ ও সচেতনতা
4. জেলেদের জন্য ভর্তুকি ভিত্তিক ডিজেল প্রদান
৫. বাজার মনিটরিং ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দমন
৬. সীমিত ও সুনির্দিষ্ট দেশের জন্য ইলিশ রপ্তানি নির্ধারণ
🍽️ সাধারণ মানুষ কীভাবে সামলাবে?
বর্তমানে যেহেতু ইলিশের দাম অনেক বেশি, তাই সাধারণ মানুষকে সচেতনভাবে পরিমিত হারে কেনা, ওজন ও দামের সঠিক তুলনা করে কেনা এবং প্রয়োজন না হলে বিকল্প মাছ গ্রহণ করার পরামর্শ দেওয়া যায়।
ইলিশ মাছ আমাদের ঐতিহ্যের প্রতীক। কিন্তু বর্তমানে এর দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটি শুধু অর্থনৈতিক নয়, পরিবেশ ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার দুর্বলতারও প্রতিফলন। তাই ইলিশ সংরক্ষণ ও বাজার নিয়ন্ত্রণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে একসাথে কাজ করতে হবে সরকার, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, জেলে সমাজ এবং ভোক্তা মহলকে।
যদি আমরা সবাই সচেতন হই এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেই, তাহলে আবারও ইলিশ ফিরে আসবে আমাদের প্রতিদিনের পাতে – আগের মতোই সুস্বাদু, সহজলভ্য ও স্বস্তিকর।