
আফগানিস্তানে তালিবান শাসন ব্যবস্থা
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে। দীর্ঘ ২০ বছরের যুদ্ধ এবং অস্থিতিশীলতার পর তালেবান সরকার গঠন করে দেশটিকে একটি ইসলামিক আমিরাত হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দেয়। যদিও তালেবানের শাসন নিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্ক এবং উদ্বেগ রয়েছে, তবুও তাদের শাসনামলে আফগানিস্তানে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। এই আর্টিকেলে আমরা তালেবানের শাসন আমলে আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক, সামাজিক, এবং নিরাপত্তার ক্ষেত্রে অর্জিত অগ্রগতি এবং তাদের প্রভাব বিশ্লেষণ করব।
## অর্থনৈতিক অগ্রগতি
### পপি চাষ নিষিদ্ধকরণ এবং মাদক নিয়ন্ত্রণ
তালেবানের শাসন আমলে আফগানিস্তানের অর্থনীতিতে একটি বড় পরিবর্তন এসেছে পপি চাষ নিষিদ্ধকরণের মাধ্যমে। আফগানিস্তান দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বের আফিম উৎপাদনের প্রায় ৮০% সরবরাহ করতো। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমা সমর্থিত সরকার এই পপি চাষ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে, তালেবান সরকার ২০২২ সালে পপি চাষের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলস্বরূপ, ২০২৩ সালে পপি চাষের জমি ২,৩৩,০০০ হেক্টর থেকে কমে ১০,৮০০ হেক্টরে নেমে আসে। এই পদক্ষেপ মাদক পাচার এবং আফিম-সম্পর্কিত অপরাধ কমিয়ে আনতে সহায়ক হয়েছে। এটি আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে বৈধ ফসল এবং বিকল্প কৃষির দিকে ঝুঁকতে উৎসাহিত করেছে।
### অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং রাজস্ব বৃদ্ধি
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে আফগানিস্তানের অর্থনীতি সংকোচনের ধারা থেকে বেরিয়ে এসেছে। ২০২৫ সাল পর্যন্ত ২-৩% অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে। ২০২২ সালে মূল্যস্ফীতি ১৮.৩% থেকে ৯.১% এ নেমে আসে, যা অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ইঙ্গিত দেয়। তালেবান সরকার ২০২২ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ১৫৪ কোটি ডলার রাজস্ব আদায় করেছে। রপ্তানি আয়ও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৯০% বেড়ে ১.৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এই অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা তালেবান সরকারের কঠোর দুর্নীতি দমন নীতির ফলাফল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।[](https://dailyinqilab.com/editorial/article/652596)
### শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়ন
তালেবান সরকার শিল্প ও বাণিজ্য খাতে উন্নয়নের জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ২০২৫ সালের হিসাবে, আফগানিস্তানে ৬,৫০০টি কারখানা কার্যকর রয়েছে। তালেবানের বাণিজ্য মন্ত্রী জানিয়েছেন, গত এক বছরে ২,০০০ পানাগোয়াল বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন এবং শিল্পাঞ্চলের জন্য ৮০,০০০ হেক্টর জমি বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া, ১০০টি দেশের সাথে ১৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই উদ্যোগগুলো আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
### আঞ্চলিক সহযোগিতা
তালেবান সরকার চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার এবং পাকিস্তানের সাথে অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। উজবেকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বখতিয়ার সাইদভ বলেছেন, আফগানিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়েছে এবং বড় অর্থনৈতিক প্রকল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই আঞ্চলিক সহযোগিতা আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
## নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা
### আইনশৃঙ্খলার উন্নতি
তালেবানের শাসন আমলে আফগানিস্তানে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়েছে। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশটি অবিরাম যুদ্ধ এবং সন্ত্রাসী হামলার মুখোমুখি হয়েছিল। তবে, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশজুড়ে সংঘাত উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে। তালেবানের ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী মাওলানা আব্দুল কবির বলেছেন, ২০ বছরের সফল জিহাদের ফলে আমেরিকা ও ন্যাটো জোট পরাজয় বরণ করেছে, এবং দেশে পূর্ণ ইসলামিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি আরও জানিয়েছেন, তালেবান আর কাউকে আফগানিস্তানে আক্রমণের সুযোগ দেবে না।[](https://insaf24.com/news/30/01/2024/180648)
### অপরাধ দমন
তালেবান সরকার কঠোর শরিয়া আইন প্রয়োগের মাধ্যমে দুর্নীতি এবং অপরাধ দমনে সফলতা দেখিয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে তাদের প্রথম শাসনামলেও তারা দুর্নীতি দমন এবং আইনশৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। বর্তমানে, তালেবানের কঠোর নীতির ফলে চুরি, হত্যা এবং অন্যান্য অপরাধের হার কমেছে। এটি দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে নিরাপত্তার অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।[](https://www.bbc.com/bengali/news-58091924)
## সামাজিক উন্নয়ন
### শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে উদ্যোগ
তালেবান শাসন আমলে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যদিও নারী শিক্ষা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, তবে তালেবান ছেলেদের শিক্ষার জন্য বিভিন্ন মাদ্রাসা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে। খোস্ত প্রদেশে মাম্বাউল জিহাদ মাদ্রাসার শিক্ষা সমাপনী অনুষ্ঠানে তালেবান নেতারা শিক্ষার গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছেন। স্বাস্থ্য খাতে, তালেবান সরকার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সাথে সহযোগিতার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার চেষ্টা করছে।[](https://insaf24.com/news/30/01/2024/180648)
### কৃষি খাতে উন্নয়ন
আফগানিস্তানের কৃষি খাতে তালেবানের শাসন আমলে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। পশ্চিমাঞ্চলীয় হেরাত প্রদেশে জাফরান চাষের মতো বিকল্প কৃষি উদ্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়ী আজিজুল্লাহ রেহমাতি জানিয়েছেন, তার জাফরান ব্যবসা দিন দিন বড় হচ্ছে এবং এ বছর দ্বিগুণ উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে। এই ধরনের উদ্যোগ কৃষকদের আয় বাড়াতে এবং পপি চাষের বিকল্প হিসেবে কাজ করছে।[](https://www.prothomalo.com/business/world-business/4yelngnwlj)
## আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
তালেবান সরকার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। যদিও কোনো দেশ এখনও তাদের সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবে চীন, রাশিয়া এবং অন্যান্য আঞ্চলিক শক্তির সাথে নিয়মিত বৈঠক এবং আলোচনা চলছে। তালেবানের প্রতিনিধিরা জাতিসংঘের উদ্যোগে আয়োজিত বিভিন্ন বৈঠকে অংশ নিয়েছে। এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা আফগানিস্তানের বিশ্ববাজারে পুনঃপ্রবেশ এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সহায়ক হচ্ছে।
## চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
তালেবানের শাসন আমলে আফগানিস্তানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নারী শিক্ষা এবং মানবাধিকার নিয়ে আন্তর্জাতিক সমালোচনা তালেবান সরকারের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। এছাড়া, দুর্বল অবকাঠামো এবং বিশেষজ্ঞের অভাব দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। তবে, তালেবানের কঠোর নীতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতার প্রচেষ্টা ভবিষ্যতে আরও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে।
## উপসংহার
তালেবানের শাসন আমলে আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি পরিলক্ষিত হয়েছে। পপি চাষ নিষিদ্ধকরণ, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, শিল্প ও বাণিজ্য উন্নয়ন, এবং নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি দেশটিকে একটি নতুন দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তবে, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে পারলে তালেবান সরকার আফগানিস্তানকে আরও সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যেতে পারে। এই অগ্রগতি আফগানিস্তানের জনগণের জন্য আশার আলো হিসেবে কাজ করছে।